ফ্যাশনে যখন স্পেসস্যুট

বিনা। ইভেন্ট
নেভি ব্লু বডিকন ড্রেস, সঙ্গে স্টাইলিশ ম্যান্ডারিন কলার। কোমরে কালো বেল্ট আর পোশাকজুড়ে জিপার। প্রথম দেখায় যে কেউ ভাবতেই পারেন, কোনো ফ্যাশন উইকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মডেলরা? কোন তারকা র্যাম্প মাতাবেন এই পোশাকে? আদতে সম্প্রতি এই পোশাক গায়ে চাপিয়েছেন পপ তারকা কেটি পেরি। আর পোশাক তৈরি করেছেন ডমিনিকান রিপাবলিকের ফার্নান্দো গার্সিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার লরা কিমের মতো হেভিওয়েট ফ্যাশন ডিজাইনার। কিন্তু এই পোশাক কোনো ফ্যাশন শো কিংবা র্যাম্পে শোভাবর্ধন করেনি; বরং পরেছেন মহাকাশচারীরা।
১৪ এপ্রিল মহাকাশভ্রমণে যান পপ তারকা কেটি পেরি। ১১ মিনিটের মহাকাশযাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক গেইল কিং, সমাজসেবী লরেন সানচেজ, মহাকাশ প্রকৌশলী আইশা বোয়ি, বায়ো-অ্যাস্ট্রোনটিকস গবেষক আমান্ডা নুয়েন ও চলচ্চিত্র প্রযোজক কেরিয়ান ফ্লিন। অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও মার্কিন ধনকুবের জেফ বেজোসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিনের মহাকাশযানে করে সাব-অরবিটাল স্পেসে ভ্রমণ করেন তাঁরা। ‘ব্লু অরিজিন এনএস-৩১’ মহাকাশ মিশন একটা রেকর্ডও বটে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম মহাকাশ অভিযান, যেখানে অংশ নিয়েছেন কেবলই নারীরা। ১৯৬৩ সালে রুশ নারী নভোচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভার একক মহাকাশযাত্রার পর এবারই প্রথম শুধু নারীদের নিয়ে মহাকাশ ভ্রমণ করেছে কোনো মহাকাশযান।
কেটি পেরির মহাকাশযাত্রা নজর কেড়েছে ঠিক অন্য একটা কারণে। মহাকাশযাত্রা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই ঝুঁকিতে নভোচারীদের ভরসা থাকে ভারী স্পেসস্যুটে। যেখানে প্রতিমুহূর্তে নিশ্চিত করা হয় অক্সিজেন। সামান্যতম ভুলের অবকাশ থাকে না সেখানে। চাঁদে যখন প্রথমবারের মতো পা রাখেন নিল আর্মস্ট্রং, তখন তাঁর কাঁধে ছিল অক্সিজেনের ট্যাংক, গায়ে ভারী স্পেসস্যুট। সেখান থেকে আজকের নীল বডিকন স্যুট, নভোযাত্রায় এত পরিবর্তন এল কীভাবে?
এ জন্য অবশ্য খুব একটা পেছন ফিরতে হবে না। মর্ত্যলোক জয় করে মহাকাশের পথে পা বাড়ানোর অঙ্গীকার ফ্যাশনজগতে বহুদিন ধরে। তার একমাত্র উপায় মহাকাশচারীদের জন্য আলাদা পোশাক তৈরি করা। নভোচারীদের পোশাক আর ফ্যাশনজগৎ তো এক নয়। তাঁদের পোশাকের ধরন, কাপড়ের মান থেকে শুরু করে সেলাই—সবকিছুতে থাকে ভিন্নতা। একচুল এদিক-সেদিক হলে শুধু নভোচারী নয়, পুরো মহাকাশযাত্রা পড়তে পারে সংকটে। তাই ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো উদ্যোগ হাতে নিলেও বেশ কয়েকবার পিছিয়ে এসেছে শুধু সঠিক উপকরণের অভাবে।
২০১৬ সালে প্রথম ডিজাইনার স্পেসস্যুটের আইডিয়া নিয়ে আসেন ইলন মাস্ক। ‘আয়রনম্যান’, ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান’ সিনেমার কস্টিউম ডিজাইনার হোসে ফার্নান্দেসকে নিয়ে আসেন স্পেসএক্সে। লক্ষ্য ছিল নভোচারীদের ‘সুপারহিরো’ বানানোর। দূর থেকে দেখেই যাতে তাঁদের হিরো বলে মনে হয়। প্রথমবারের মতো মিনিমালিস্টিক স্পেসস্যুটের দেখা পায় বিশ্ব। ২০২০ সালে সেই স্পেসস্যুট গায়ে চাপিয়ে মহাকাশযাত্রা সম্পন্ন করেন দুই মার্কিন নভোচারী ডগ হার্লি ও বব বেনকেন। তবে সেটা কোনো ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ ছিল না। ছিল ইলন মাস্কের পাগলামির ফসল।
২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো ঘোষণা আসে, ইতালীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাডা সরাসরি কাজ করতে চলেছে স্পেসস্যুট নিয়ে। তখন জানা যায়, টেক্সাস-ভিত্তিক অ্যারোস্পেস কোম্পানি অ্যাক্সিওম স্পেস বানাতে চলেছে ডিজাইনার স্পেসস্যুট। নাসার ‘আর্টেমিস ৩’ অভিযানের জন্য প্রাডার তৈরি স্পেসস্যুট প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের অক্টোবরে। সাদার সঙ্গে লাল ও ধূসর রঙের মিশ্রণে তৈরি স্পেসস্যুটটি অনেকের নজর কাড়ে। সেখানে অবশ্য অক্সিজেন ট্যাংক, হেলমেট—সবকিছুই ছিল। স্যুটটি তৈরি করা হয়েছে চাঁদের ধুলা ও তাপমাত্রাসহনীয় উপাদানে। ২০২৭ সালে চাঁদের উদ্দেশে পৃথিবী ছাড়বে ‘আর্টেমিস ৩’।
তবে কেটি পেরিদের স্যুট বানাতে বেশ বিপত্তিতে পড়তে হয়েছিল গার্সিয়া-কিম জুটিকে। সাধারণত স্পেসস্যুট বানানো হয় পুরুষদের কথা ভেবে। নারী নভোচারীদের জন্য আলাদা কিছু করার লক্ষ্য ছিল তাঁদের। শুধু তা-ই নয়, যেখানে নভোচারী হিসেবে আছেন কেটি পেরি, গেইল কিংয়ের মতো তারকা, সেখানে হেলাফেলার প্রশ্ন আসে না। তাই মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘মনসে’ স্পেসস্যুট তৈরি করেছে নারী নভোযাত্রীদের আরাম ও স্বস্তির কথা মাথায় রেখে। প্রত্যেকের জন্য তৈরি করা হয়েছিল আলাদা আলাদা স্পেসস্যুট। এর সঙ্গে নারী নভোযাত্রীদের পরনে ছিল কিম কার্ডাশিয়ানের লেবেল ‘স্কিমস’-এর শেপওয়্যার। ১১ মিনিটের মহাকাশযাত্রায় শুধু রেকর্ড নয়, ফ্যাশনটাও যে ছিল মুখ্য।
কেটি পেরির নভোযাত্রা নতুন ট্রেন্ড তৈরি করল ফ্যাশনজগতে। ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলো পানির নিচ থেকে পৌঁছে গেল মহাকাশের গহিনে। ভবিষ্যৎ নভোচারীদের বিভিন্ন রূপে দেখা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।